সোনার তরী (কাব্য গ্রন্থ)
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সোনার তরী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি কাব্য গ্রন্থ । এই কাব্য গ্রন্থে প্রত্যাখান, লজ্জা, পুরস্কার, বসুন্ধরা ও নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতা গুলো রয়েছে |
[সম্পাদনা] প্রত্যাখান
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না |
অমন সুধাকরুণ সুরে গেয়ো না |
সকালবেলা সকল কাজে আসিতে যেতে পথের মাঝে
আমারি এই আঙিনা দিয়ে যেয়ো না |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না |
মনের কথা রেখেছি মনে যতনে |
ফিরিছ মিছে মাগিয়া সেই রতনে |
তুচ্ছ অতি, কিছু সে নয়- দুচারি-ফোঁটা-অশ্রু-ময়
একটি শুধু শোণিতরাঙা বেদনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||
কাহার আশে দুয়ারে কর হানিছ !
না জানি তুমি কী মোরে মনে মানিছ |
রয়েছি হেথা লুকাতে লাজ, নাহিকো মোর রানীর সাজ--
পরিয়া আছি জীর্ণচীর বাসনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||
কী ধন তুমি এনেছ ভরি দু হাতে ?
অমন করি যেয়ো না ফেলি ধুলাতে |
এ ঋণ যদি শুধিতে চাই কী আছে হেন, কোথায়
পাই-
জনমতরে বিকাতে হবে আপনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||
ভেবেছি মনে, ঘরের কোণে রহিব |
গোপন দুখ আপন বুকে বহিব |
কিসের লাগি করিব আশা- বলিতে চাহি, নাহিকো
ভাষা-
রয়েছে সাধ, না জানি তার সাধনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||
যে সুর তুমি ভরেছ তব বাঁশিতে
উহার সাথে আমি কি পারি গাহিতে !
গাহিতে গেলে ভাঙিয়া গান উছলি উঠে সকল প্রাণ,
না মানে রোধ অতি অবোধ রোদনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||
এসেছ তুমি গলায় মালা ধরিয়া,
নবীনবেশ শোভনভূষা পরিয়া |
হেথায় কোথা কনকথালা, কোথায় ফুল, কোথায়
মালা-
বাসরসেবা করিবে কেবা রচনা !
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||
ভুলিয়া পথ এসেছ, সখা, এ ঘরে-
অন্ধকারে মালা-বদল কে করে !
সন্ধ্যা হতে কঠিন ভূ একাকী আমি রয়েছি শুয়ে,
নিবায়ে দীপ জীবননিশি-যাপনা |
অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ||
২৭ আষাঢ় ১৩০০
[সম্পাদনা] লজ্জা
আমার হ্রদয় প্রাণ সকলই করেছি দান,
কেবল শরমখানি রেখেছি |
চাহিয়া নিজের পানে নিশিদিন সাবধানে
সযতনে আপনারে ঢেকেছি ||
হে বঁধু, এ স্বচ্ছ বাস করে মোরে পরিহাস,
সতত রাখিতে নারি ধরিয়া;
চাহিয়া আঁখির কোণে তুমি হাস মনে মনে
আমি তাই লাজে যাই মরিয়া ||
দক্ষিণপবনভরে অঞ্চল উড়িয়া পড়ে
কখন্ যে নাহি পারি লখিতে;
পুলকব্যাকুল হিয়া অঙ্গে উঠে বিকশিয়া
আবার চেতনা হয় চকিতে ||
বদ্ধ গৃহে করি বাস রুদ্ধ যবে হয় শ্বাস
আধেক বসনবন্ধ খুলিয়া
বসি গিয়া বাতায়নে সুখসন্ধ্যাসমীরণে
ক্ষণতরে আপনারে ভুলিয়া ||
পূ্র্ণচন্দ্রকররাশি মূর্ছাতুর পড়ে আসি
এই নবযৌবনের মুকুলে;
অঙ্গ মোর ভালোবেসে ঢেকে দেয় মৃদু হেসে
আপনার লাবণ্যের দুকূলে ||
মুখে বক্ষে কেশপাসে ফিরে বায়ু খেলা-আশে,
কুসুমের গন্ধ ভাসে গগনে;
হেনকালে তুমি এলে মনে হয় স্বপ্ন ব'লে-
কিছু আর নাহি থাকে স্মরণে ||
থাক্ বঁধু, দাও ছেড়ে, ওটুকু নিয়ো না কেড়ে,
এ শরম দাও মোরে রাখিতে-
সকলের অবশেষ এইটুকু লাজলেশ
আপনারে আধখানি ঢাকিতে ||
ছলছল-দু'নয়ান করিয়ো না আভিমান-
আমিও যে কত নিশি কেঁদেছি;
বুঝাতে পারি নে যেন সব দিয়ে তবু কেন
সবটুকু লাজ দিয়ে বেঁধেছি ||
কেন যে তোমার কাছে একটু গোপন আছে,
একটু রয়েছি মুখ হেলায়ে-
এ নহে গো অবিশ্বাস, নহে, সখা, পরিহাস-
নহে নহে ছলনার খেলা এ |
বসন্তনিশীথে, বঁধু, লহো গন্ধ, লহো মধু,
সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো-
দিয়ো দোল আশে-পাশে, কোয়ো কথা মৃদু ভাষে,
শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো ||
সেটুকুতে ভর করি এমন মাধুরী ধরি
তোমা-পানে আছি ফুটিয়া,
এমন মোহনভঙ্গে আমার সকল অঙ্গে
নবীন লাবণ্য যায় লু্টিয়া-
এমন সকল বেলা পবনে চঞ্চল খেলা,
বসন্তকুসুম-মেলা দুধারি |
শুন, বঁধু, শুন তবে সকলই তোমার হবে-
কেবল শরম থাক্ আমারি ||
২৮ আষাঢ় ১৩০০