শিল্প
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সাধারণ দৃশ্যমান জগতে আমরা যে চিরায়ত লীলার অভিজ্ঞতা লাভ করি তাকে প্রকৃতি হিসেবে অভিহিত করা হয়, তা শিল্প নয়। এই প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অবলোকন করে মানব মন যখন বিমুগ্ধ, বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে যায় তখন সে তাকে নিজের মধ্যে আপন করে পেতে চায়। এরই ধারাবাহিকতায় সে চায় এই নৈসর্গিকতাকে একটি স্বাভাবিক রুপ দিতে। আর এর মাধ্যমেই জন্ম হয় শিল্পের।অর্থাৎ :
- চিরায়ত ও চিরন্তন নৈসর্গিক প্রকৃতিকে শিল্পীর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত রং, রেখা, শব্দ বা রূপকের আশ্রয়ে প্রকাশ করে সেই অনুভূতি অন্যের মনে সঞ্চারের মাধ্যমে একটি পরিচয়বোধের সঞ্চারণ ঘটানোকেই শিল্প বা Art হিসেবে অভিহিত করা হয়।
অন্য কথায় দৃশ্য বা অদৃশ্যকে শিল্পীর চিত্তরসে রসায়িত করে যে স্থিতিশীল রূপ মহিমা দান করা হয় তা-ই শিল্প। এর অপর নাম চারুশিল্প, কারুশিল্প, ললিতকলা, চারুকলা ইত্যাদি। যে শিল্পের এই সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করে সে হচ্ছে শিল্পী বা Artist। শিল্পী মাত্রই রূপ-বিলাসী এবং তার সৃষ্ট রূপই হল শিল্প।
সূচিপত্র |
[সম্পাদনা] পরিচয়বোধ সঞ্চার
প্রকৃতপক্ষে প্রথম মানুষ যখন প্রকৃতির অপার রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ ও এর সৌন্দর্য্যের স্রোতকে উপলব্ধি করেছিল তখনই সে চেয়েছিল এই অনুভূতিকে বিশ্বসৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে অন্যের মনে সঞ্চারিত করতে আর তারই সূত্র ধরে প্রেম মোহিত প্রতিটি সৃষ্টির সম্মিলন ঘটাতে; কারণ মানৃষের স্বাভাবিক প্রকৃতির এটিই দাবী। কিন্তু প্রকৃতি মানুষে মানুষে এ ধরণের সম্মিলন ঘটানোর জন্য বিশেষায়িত নয় বরং প্রকৃতি কেবল সবার মনে তার রসবোধের সঞ্চার ঘটাতে পারে, আর তাও একেকজনের ক্ষেত্রে একেক ধরণের হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এজন্যই এই অনুভূতি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার নিমিত্তে তাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে শিল্পের। মানুষ না থাকলে শিল্পের সৃষ্টির প্রশ্নই উঠত না এবং শিল্পের ইতিহাস ও মানবসন্তানের ইতিহাস একই ধারায় প্রবাহিত। এই শিল্প মানুষে মানুষে কেবল অনুভূতির সঞ্চার ঘটিয়েই ক্ষান্ত থাকলে এই সম্মিলন সম্ভব ছিলনা। তাই শিল্পের মূল উদ্দেশ্য এখানে পরিস্ফূটিত হয়েছে আর তা হল পরিচয়বোধ-সঞ্চার যাকে ইংরেজিতে Transmission of Understanding বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ শিল্পের মাধ্যমে শিল্পীমন ও দ্রষ্টার মনের পরিচয় হয়ে যায় এবং তা হয় অত্যন্ত গভীর। এর ফলে দেখা যায় শিল্পের সৌন্দর্য্য দেখে দ্রষ্টা শিল্পীমনের অতি কাছাকাছি আসে এবং এর ফলে আত্মপরিচিতি আবিষ্কারের পথ খুঁজে পায়।
[সম্পাদনা] শিল্পের বৈশিষ্ট্য ও উদ্দেশ্য
- মানুষ একান্তই অনুকরণপ্রিয়। সাধারণ মতে এই অনুকরণের প্রবৃত্তি হতেই শিল্পের জন্ম। তবে অনেকের মত গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর মতে একে কেবল অনুকরণাত্মক বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। শিল্পীর মনের স্পর্শবিহীন অনুকরণ কেবলই যান্ত্রিক, তা কখনই শিল্প হতে পারেনা। শিল্পীর অন্যতম উদ্দেশ্য যেহেতু বাহিরকে আপন অন্তরে বন্দী করা এবং নিজের অন্তরকে বাহির করা তাই এর সাথে মনের সংযোগ অবশ্যম্ভাবী। এটি শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- যা অদৃশ্য ও অনধিগম্য শিল্প তাকে দৃশ্যমান অধিগম্য করে। শিল্প ক্ষণস্থায়ী জীবনের চঞ্চল স্রোতকে ক্ষণ-সৌন্দ্যর্যের মাঝে বন্দী করে স্থিতিশীলতা দান করে; কারণ জীবনে থাকে চঞ্চলতা আর শিল্পে স্থিতি। জীবন শেষ হয়ে যায় কিন্তু শিল্প এই সসীম জীবনের ক্ষণ-সৌন্দ্যর্যটিকে শান্ত শ্রী দান করে চিরদিনের করে রাখে। সুতরাং শিল্প চলমান জীবনের স্থিতিমান মুহূর্তের চিরন্তন প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের একটি পদ্যাংশ কিভাবে চিরায়ত রূপ লাভ করেছে তা এখানে দেখা যেতে পারে:
হে সৌম্য বিষাদ।
ক্ষণেক দাঁড়াও স্থির মুছায়ে নয়ননীর
[সম্পাদনা] শিল্পের বিশেষত্ব ও সম্পর্ক
[সম্পাদনা] বিশেষ ও নির্বিশেষ
দ্রষ্টা যখন কোন রূপসৌন্দর্য্যকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গ্রহন করে তখনই রূপবন্ধ বা Form এর আবির্ভাব ঘটে। একে মানব মনের Answering quality বলা হয়। মূলত শিল্পীর একটি গুণের কারণেই এ ধরণের গুণগত মানের সৃষ্টি হয়। এই গুণটিই হল শিল্পীর মনের বিশেষত্ব এবং নির্বিশেষ মনোভূমি। শিল্পী চান দ্রষ্টা হিসেবে প্রথমে তিনি যে অনুভূতি আপন অন্তরে একান্তভাবে গ্রহন করেছিলেন তাকে অন্তরের বাইরে স্থিতি বা সত্তা প্রদান করতে। কারণ সেই অনুভূতিগুলো একান্তই তার ব্যক্তিগত নয় বরং এর একটি সর্বজনীনতা আবশ্যক। এখানে ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির সঞ্চারণই হল বিশেষ আর তাকে ছড়িয়ে দেয়াই হল শিল্পের নির্বিশেষ পরিচয়। একে অন্যভাবেও চিহ্নিত করা যায়; শিল্পের সৃষ্টি তখনই হয় যখন বাস্তব জীবনের কোন একটি উপকরণের অসংখ্য নির্বিশেষ রূপবন্ধের মধ্যে কেবল একটি বিশেষ রূপবন্ধের বিশেষায়িত আলোচনা সম্ভব হয় এবং এই বিশেষের মাধ্যমেই নির্বিশেষের ব্যঞ্জনা লভিত হয়। অর্থাৎ শিল্পে নির্বিশেষ বলতে উপকরণগত সাধারণত্ব বুঝায়না বরং বিশেষের শৈল্পিক স্থিতির একটি সাধারণ ব্যঞ্জনা বুঝায়।